Thursday, October 18, 2018

আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি, যা হওয়ার তাদেরই হয়েছে

নামকরা চিকিৎসক তিনি। জিয়াউর রহমানের আগ্রহে রাজনীতিতে এলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাড়ে সাত মাস দায়িত্ব পালনের পর পদত্যাগ করে নতুন দলও গড়েছেন। ১১ অক্টোবর ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য জীবনে ফিরে গেলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। শুনেছেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান.

 

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল?
 
রাষ্ট্রপতি জিয়া পরে নিজেই আমাকে বলেছেন যে তিনি টিভিতে আমার স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক, এমনকি ‘ভক্ত’ও ছিলেন। প্রফেসর ইব্রাহীম যখন তাঁর উপদেষ্টা হন, সেই সময় একটি অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে দেখে কাছে ডেকে বললেন, ‘স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু কথা আছে। সময় করে আসতে পারবেন?’ ১৯৭৮ সালে, সেই থেকে পরিচয়।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হওয়ার পেছনের গল্পটি?
প্রথমে তো আমার খুব গা ছাড়া ভাব ছিল। এর ভেতরে ঢুকতে চাইনি, রাজনীতি করবই না মনে করেছি। তখন তিনি বললেন, ‘যিনি দলের মহাসচিব থাকবেন, তাঁর কি মন্ত্রী হওয়া উচিত? আপনার কী মনে হয়?’ বললাম, আসলে তাঁর মন্ত্রী হওয়া উচিত নয়। আপনি তো রাষ্ট্রপতি, আপনাকে আপনার মতোই থাকতে হবে, কিন্তু মহাসচিবকে পুরো দল চালাতে হবে বলে তাঁর মন্ত্রী থাকা উচিত নয়, কিন্তু তিনি যদি সংসদ সদস্য হওয়ার পর মহাসচিব হন এবং তিনি সংসদের উপনেতা হন, তাতে সংসদের ওপর ক্ষমতা বিস্তার করতে পারবেন। তবে মন্ত্রী-এমপিদের চেয়ে তাঁর ক্ষমতা অনেক বেশি থাকা উচিত। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু আমরা তো গণতান্ত্রিকভাবে মহাসচিব নির্বাচন করতে চাই।’ বললাম, অবশ্যই গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচন করতে হবে। আন্দাজে কেন মহাসচিব নির্বাচন করবেন? এসব কথা মাথায় নিয়ে তিনি যে মনে মনে আমাকেই সে পদের জন্য ঠিক করে রাখবেন, সেটি আমি জানতাম না। তিনি সিলেকটেড বাট গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মহাসচিব করতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি সব জেলার প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিকে একজন একজন করে ডাকা শুরু করলেন। তাঁদের বললেন, ‘আমাকে এমন একটি নাম বলেন, যাঁকে আপনি সৎ বলে জানেন, যে জীবনে ঘুষ খায়নি, যাঁর রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এবং সে শিক্ষিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।’ তাঁরা নাম দিলেন, তিনি নোট করলেন।

এরপর কী হলো?
বিভিন্ন জেলার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিরা আরো দু-তিনজনের নাম বললেও তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশই আমার নাম বলেছেন। জেনারেল শিশুর [নুরুল ইসলাম শিশু] খুব আগ্রহ ছিল, কিন্তু তাঁকে মহাসচিব করলে দুজনই সেনাবাহিনীর লোক হয়ে যান বলে জিয়াউর রহমান সেটি চাননি। ভালো কাজগুলো তিনি শুক্রবার করতেন। একদিন আমাকে বললেন, ‘এই শুক্রবার একটু আসেন।’ গেলাম। দেখি, তিনি ও উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার বসে আছেন। তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন, সেদিনই আমাকে মহাসচিব করবেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি তো গণতান্ত্রিকভাবেই মহাসচিব করার চেষ্টা করেছি। আপনি বলছেন যে মহাসচিব হবেন না, কিন্তু আমি তো মুশকিলে আছি। কোন জেলার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কী বলেছেন এই খাতায় নোট করা আছে। খাতাটি দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। তাঁরা আরো দু-তিনজনের নাম বললেও অনেক বেশিসংখ্যকই আপনার নাম বলেছেন। এখন আপনি যে মহাসচিব হবেন না বলছেন, এটি কেমন দেখা যায়? কী মনে হয় আপনার?’ আমি বললাম, মাফ করবেন, মহাসচিব হওয়ার মতো যোগ্য লোক আপনার পার্টিতে আরো অনেকে আছেন, তাঁদের মধ্যে কাউকে করেন। সত্যি কথা যে আপনার সঙ্গে উপদেষ্টা হওয়া ছাড়া আমার আর কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। তিনি বললেন, ‘আমি তো সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম। তাঁরা আপনার কথা বলেছেন।’ তখন বললাম, মহাসচিব যে আমি হতে চাই না, তার অনেকগুলো কারণ আছে। একটি হলো—দলের নেতারা রাস্তায় লাশ পড়লে ‘আমাদের দলের লাশ’ বলে সেটি কাঁধে নিয়ে দৌড়ায়, এটি আমি করতে পারব না। তিনি বললেন, ‘আমিও আপনাকে তা করতে বলি না।’ বললাম, কোটি কোটি টাকার পার্টি ফান্ড জোগাড় করে, এটি করতে পারব না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি বলে দেব। আপনাকে ফান্ড জোগাড় করতে হবে না।’ তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা রেখেছেন। কখনো চাঁদা সংগ্রহে আমি যাইনি। শেষ কথা বলেছি, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারব না। তিনি বললেন, ‘আমিও বলি নাই, আপনিও বলবেন না।’ এই তিন শর্তে ১৯৭৯ সালে মহাসচিব হলাম।

এরপর তো উপ-প্রধানমন্ত্রী হলেন।
নির্বাচনের পর তিনি বললেন, ‘আমার তো ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আপনার চেষ্টা তো দূরে থাকুক, ইচ্ছাটাও নেই। আপনাকে তো প্রধানমন্ত্রী করা যায় না। তাই শাহ আজিজ (শাহ আজিজুর রহমান) আছেন, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে হলো। ভেবে রেখেছি, আপনার উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। এই পদ আপনাকে অফার করছি।’ বললাম, অনেক ধন্যবাদ। আমি গ্রহণ করছি, তাহলে রাজনীতি শিখতে পারব। এ কথা বলার পর আবদুস সাত্তার সাহেব, আইনজীবী তো, তিনি বললেন, ‘মওদুদ (আহমদ) তো পলিটিক্যাল লোক, অনেক দিন থেকে আছে, তাকে এই পদ না দিলে সে খুব রাগ করবে।’ কাজেই মওদুদকেও উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হলো। তখন আবার চট্টগ্রামের অর্থনীতিবিদ জামাল উদ্দিন আহমেদ খুব রাগ করলেন। জিয়াউর রহমান তখন বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনিও উপ-প্রধানমন্ত্রী হবেন। তবে বি চৌধুরীর নামের আগে সিনিয়র উপ-প্রধানমন্ত্রী লেখা থাকবে।’

এই পদটি রদ করা হলো কিভাবে?
১৯৮০ সালের পর যখন খালেদা জিয়া এলেন, তিনি সংসদে একটি কমিটি করে দিলেন। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দল। তাদের উপনেতা আবদুস সামাদ আজাদ একদিন ফোন করে তাঁর সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘ইটা কিতা কয়?’ বললাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, ‘আপনার নেত্রী আমারে ফোনে কইয়া দিল যে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদটা বাদ দিতে হইব।’ এই আমার কানে পানি ঢুকল যে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ বাদ দিলে কার লাভ? কী লাভ? এ কমিটির প্রধান ছিলেন শেখ রাজ্জাক আলী। তিনি আমাকে বললেন, ‘নেত্রী এ কী বলছেন? তিনি তো আমাকে বলছেন যে এটি বাদ দিতে হবে।’ আমি উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, এটাই ছিল প্রধান কারণ। পদত্যাগ করে আমি চলে যেতে পারতাম। তখন সবাই বলতেন, খামকা কেন পদত্যাগ করলেন? বিএনপিকে ফেলে রেখে চলে গেলেন? তাই নিজেকে বোঝালাম, একটি পদই তো মাত্র, রয়ে গেলাম। 

জিয়াউর রহমান যখন মারা যান তখন আপনি তো তাঁর পাশের রুমে ছিলেন।
এটি সত্য যে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আমি তাঁর উল্টো দিকের রুমে ছিলাম। এই হলো (ছবি এঁকে দেখালেন) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ওঠার সিঁড়ি। দোতলায় এখানে রাষ্ট্রপতি জিয়ার ঘর, মাঝখানে ফাঁকা ওপেন স্পেস দিয়ে বারান্দায় যাওয়ার পথ, এখানে আমার। আমি তাঁর বিপরীত দিকের ঘরে ছিলাম। আমার ঘরে আমি একা ছিলাম না। এক্স স্টেট মিনিস্টার মহিবুল হাসান আমার ঘরে ছিলেন। তিনি বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এই কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও সেদিন ছিলেন। তবে সকালের প্রথম বাস ধরে তিনি ঢাকা চলে যান। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির আরো কয়েকজন সদস্যও সেদিন সেখানে ছিলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন একটি ঘরে। তাঁর দেহরক্ষীরা আরেক ঘরে। তাঁর হত্যাকারীরা আমাদের ঘরেও গুলি করেছে। এ ঘটনা নিয়ে দুবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মাধ্যমে তদন্ত হয়েছে। সেসব তদন্তের ফলাফল সরকার নিশ্চয়ই জানত। একটি হত্যা মামলায় সাক্ষীও দিয়েছি। এগুলো আর বলতে চাই না। সেই দিনের স্মৃতি মনে করতে চাই না, মন খারাপ হয়ে যায়।

তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন?
তিনি সৎ লোক ছিলেন। তিনি মানুষের ভালো ছাড়া মন্দ চাইতেন না। ভালো রাজনীতি শেখার চেষ্টা করতেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভালো লোক খোঁজার তাঁর খুব প্রবণতা ছিল। আমার প্রতি তাঁর স্পেশাল ফিলিংস ছিল।

খালেদা জিয়া কিভাবে রাজনীতিতে এলেন?
আমরা তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করলাম, আপনি রাজনীতিতে আসেন। কারণ মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনা দেশে এসেছেন। যেহেতু তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, এই ইমেজ দিয়ে তিনি আমাদের অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারেন। এই আশঙ্কা থেকে তাঁকে বললাম, এ জন্য আপনাকে রাজনীতিতে আসতে হবে। প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেন। শেষে বলেন, ‘ঠিক আছে, যত দিন আপনাদের দলের প্রয়োজন, আমি থাকব।’ এরই মধ্যে বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন, রাষ্ট্রপতিও হয়েছেন। আমরা তাঁকে অনুরোধ করার পর তিনি পদ ছেড়ে দিলেন এবং খালেদা জিয়ার দলের চেয়ারপারসন হওয়ার পথ সুগম হলো।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের জীবন?
আমরা তাঁকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে মাঠে নামলাম। জিয়াউর রহমানের কথা বলে মানুষকে একসঙ্গে করলাম। আমাদের কর্মীরা অনেকে এদিক-ওদিক চলে গিয়েছিল। তাদের সবাইকে আবার একসঙ্গে করলাম, ঢাকায় মিটিং হলো। এ সময় আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। অনেক কর্মী অত্যাচারিত হয়েছে। কেউ কেউ জেলেও গিয়েছে। এরশাদ আমাদের দলের অনেককে নানাভাবে তাঁর দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন। অনেকে চলেও গেছে। যেমন মওদুদ সাহেব। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এক স্পিকার ছিলেন, তিনিও চলে গেছেন। এমনকি শাহ আজিজও তখন খুব বিশ্বস্ত ছিলেন না। কখন চলে যান—এ ভয়ে থাকতাম। একবার অবশ্য চলেও গিয়েছিলেন। তবে মারা যাওয়ার ঠিক আগে ভালোভাবেই পার্টিতে যোগদান করেন। ততক্ষণে তাঁর শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে। এরশাদও তাঁকে খুব ভালো পজিশন দেননি। আমিই খালেদা জিয়াকে গিয়ে বললাম, বেশি দিন বাঁচবেন না, তিনি যদি জয়েন করতে চান, নিয়ে নিন। তিনি তাঁকে নিতে রাজি হলেন।

বিভিন্ন সময় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্ব পালন করেছেন।
যতবার আমরা সরকারে গেছি, সংসদের উপনেতা ছিলাম। আর যতবার বিরোধী দলে ছিলাম, বিরোধী দলের উপনেতা হয়েছি। এ দায়িত্ব খুব উপভোগ করেছি। আলোচনার সময় ‘টু দ্য পয়েন্ট’ কথা বলতাম। তাই সাধারণ মানুষ আমাকে খুব পছন্দ করত। যেকোনো বিষয়ে বড় ধরনের আলোচনা হলে অংশ নিতাম। আমার কথা সবাই—এমনকি বিরোধী দলও প্রায়ই গ্রহণ করত। সংসদে দুটি বড় বক্তৃতা দিতে হতো—যখন বাজেট পাস হতো, তখন প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করার সুযোগ পেতাম। পার্লামেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ার সময় সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা বক্তৃতা দিতেন। ব্যস্ত থাকতেন বলে তিনি [খালেদা জিয়া] সময় দিতে পারতেন না। আমি ভাগ্যবান যে তখন আমাকে বক্তৃতা দিতে হতো। বিপক্ষের সদস্যরা সারা মাস ধরে যা যা বলতেন, খাতায় নোট করে রাখতাম এবং বক্তৃতার সময় তাঁদের যুক্তিগুলো এক এক করে খণ্ডন করতাম।

অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন।
ঘুরে ঘুরে অনেক মন্ত্রণালয়ে ছিলাম। প্রথমে জিয়াউর রহমানের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, পরে পরিবার পরিকল্পনা, এরপর উপ-প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ছিলাম। শিক্ষামন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন খালেদা জিয়াকে বলেছিলাম, আমাকে রোগী দেখে রোজগার করতে হয়। এত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি বরং সরকারি দলের উপনেতার কাজটি করতে চাই। পার্লামেন্টে বসে বিরোধী দলের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কাজটি তিনি নিজে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তবে আমার পরে আর কাউকে তিনি এ পদে নির্বাচন করেননি। আর ২০০১ সালে এক মাস দুদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলাম।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পেছনের ঘটনা কী? 
খালেদা জিয়ার কাছে আমি রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। বলেছিলাম, অনেক তো রাজনীতি করলাম, বয়সও হয়ে গেছে। তখন আমার ৭০ কি ৭১ বছর। আমার ইচ্ছা, আর রাজনীতি করব না। আর আমি এ-ও মনে করি, আমাদের দলে খুব ভালো রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নেই। সুতরাং আমারই রাষ্ট্রপতি হওয়া উচিত। মান্নান ভূঁইয়াকে দিয়ে খবর পাঠালাম যে তাঁকে বলেন, আমি এই কথা বলেছি। খালেদা জিয়া আমাকে বললেন, ‘আপনি রাষ্ট্রপতি হতে চান?’ বললাম, হ্যাঁ। তবে আমি ভালো রাষ্ট্রপতি হতে চাই, একটু অন্য রকম রাষ্ট্রপতি হতে চাই। তিনি বললেন, ‘কী রকম রাষ্ট্রপতি হতে চান?’ বললাম, দলেরই মনোনীত, অথচ নিরপেক্ষভাবে চলবেন—বাংলাদেশে এমন রাষ্ট্রপতি দরকার। তিনি বললেন, ‘তার মানে কী?’ বললাম, তার মানে আপনি যদি রাষ্ট্রপতি পদে আমাকে নমিনেশন দেন, প্রাথমিক সদস্য থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য পর্যন্ত দলের সব পদ থেকে আমি পদত্যাগ করব। তিনি বললেন, ‘রিজাইন দিয়ে দেবেন?’ বললাম, হ্যাঁ, দেব। তবে আমি বুঝিনি যে এর মধ্যে কোনো রাজনীতি থাকতে পারে। কেননা তখন তিনি বললেন, ‘আপনাকে নমিনেশন দেব।’ সাদা কাগজে আমি লিখে দিলাম—‘আমি সমস্ত পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম।’ ফলে আইনের চোখে আমি দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলাম। কাজেই বিএনপি থেকে আমাকে কেউ বহিষ্কার করেনি। কারণ আমি নিরপেক্ষ হয়ে গিয়েছিলাম।

রাষ্ট্রপতির জীবন?
আমি দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি ছিলাম। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২০০২ সালের ২১ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব উপভোগ করেছি। তবে রাষ্ট্রপতির তো অনেক ক্ষমতা নেই। কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলো পালন করেছি। আমাকে কতগুলো কাউন্টার সাইন করতে হতো, যার কিছুই আমি জানি না, কিন্তু আমাকে সাইন করতে হতো। যেমন—বিসিএস যাঁরা পাস করতেন, এমন অনেককে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অধীনে চাকরি দেওয়া হতো। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেখলাম, আর্মির সিপাই থেকে শুরু করে ওপরের পর্যন্ত অনেকের নামে লিস্ট আসত, যাঁদের চিনিও না, কী কারণে তাঁদের পদচ্যুত করা হতো, সেটিও উল্লেখ থাকত না। তার পরও সই করতে হতো, মনে মনে তখন হাসতাম। কাজেই এই পদচ্যুতির ব্যাপারগুলোতে আমার মনে হতো যে এটি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বলে বলা হতো, কিন্তু রাষ্ট্রপতির আসলে কোনো ক্ষমতা ছিল না। সোজা কথা, নিয়োগ ও পদত্যাগের ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব না থাকলেও তাঁকে সই করতে হতো। এটি আমার কাছে একটু অন্য রকম লাগত যে আসলে তো তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধান অনুসারেও আসলে তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। লেখা থাকত—‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুপারিশ করিয়াছেন।’ সে জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাকে সই করতে হতো। কেউ প্রাণভিক্ষা চাইলে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আছে। তিনি প্রাণভিক্ষা করতে পারেন, না-ও করতে পারেন, কিন্তু আমি দেখলাম, রাষ্ট্রপতি নিজে থেকে সেক্রেটারিকে ডেকে বলতে পারেন না যে অমুকের নামে ফাইল বানাও। আমার কাছে প্রাণভিক্ষার একটি মাত্র ফাইল এসেছিল। তা-ও সাধারণ কেস, পলিটিক্যাল কেস নয়। এ ছাড়া পার্লামেন্টে পাস হওয়া কোনো বিল আইনে পরিণত করতে হলে রাষ্ট্রপতির সই লাগে। একে ক্ষমতার মতো দেখা যায়। সংসদ থেকে যত বিল রাষ্ট্রপতির কাছে আসে, যারা মেজরিটি থাকে তাদের বিলগুলোই সাধারণত পাস হয়ে আসে। রাষ্ট্রপতি যদি একবার বলেন যে আমি সই করব না, তাহলে বিলটি নিয়ে সংসদে আবার আলোচনা হয়। এভাবে দুইবারের পর তৃতীয়বার অটোমেটিক্যালি সেটি আইনে পরিণত হয়ে যায়। এ তো কোনো ক্ষমতা হলো না [হাসি]। তবে হ্যাঁ, এটি সম্মানিত পদ। যেমন—রাষ্ট্রপতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। এ হিসেবে তাঁর পদ সবার ওপর, কিন্তু এটি আগেও দু-একবার ঘটেছে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চলে যান।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল?
আমার তরফ থেকে হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে এমন কোনো সমস্যা দেখিনি। আমি যা বলব, সেগুলোর তো কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। এসব কথার লিখিত প্রমাণ থাকে না। যেমন—মন্ত্রী নাজমুল হুদা একদিন আমাকে এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার এক্সপোজার বেশি হয়ে যাচ্ছে। এটি ঠিক হচ্ছে না।’ বললাম, কী রকম? তিনি বললেন, ‘যেমন—ঢাকার কতগুলো স্পেশাল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে বেশি যাচ্ছেন।’ বললাম, মেডিক্যাল বলে যাচ্ছি। না হলে তো যেতাম না। তিনি বললেন, ‘না, এটা আপনাকে বলতে বলা হয়েছে।’ বললাম, ঠিক আছে। কয়েক দিন পর প্রমাণ দেখলাম, আগে আমার কোনো কনফারেন্স থাকলে বলার আগেই টিভিগুলো চলে আসত। এর পর থেকে সেক্রেটারি বললেও বিটিভি আসত না, কিন্তু প্রাইভেট চ্যানেলগুলো আসত। এটা কী কারণে হতো জানি না। এটি হুদা সাহেব নিজ দায়িত্বে বলেছেন কি না জানি না। হতে পারে। তিনি মোটামুটি চালাক লোক ছিলেন। হতে পারে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে বলেছেন; কিন্তু দূরত্বের ইনডাইরেক্ট প্রমাণ কিছুদিন পর পেয়ে গেলাম। সব সময় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে গেলে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। বলা হয়, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট করেন। আমার সময় নেপালে সার্কের কনফারেন্স হয়েছিল। ফিরে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করেননি। আমার সময় অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথের কনফারেন্স হয়েছিল। ফিরে এসে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেননি। এটি তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন বলে করেছেন কি না জানি না। রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট করা না করাতে আসলে কী আসে-যায়? এ তো তেমন কোনো ব্যাপার নয়, খুব একটা উপকারিতাও নেই। তবে ঘটনাগুলো ঘটার পর মনে হলো যে ব্যাপারটি কী? এর বেশি মনে হয়নি। আমি কারণ জানি না, কিন্তু এমন কিছু কিছু খাপছাড়া ঘটনা ঘটেছে। আমার ছেলে (মাহী বি চৌধুরী) আমার আসনে এমপি হলো। কারণ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তো আমাকে আসন ছেড়ে দিতে হলো। সে পাস করার পর আরেকটি ঘটনা ঘটল—আমাদের এলাকার ওপর দিয়ে শেখ হাসিনাকে নিজের এলাকায় যেতে হয়। তিনি যাওয়ার আগে সেখানে তোরণ তৈরি করা হলো—‘বিরোধী দলের নেত্রী, আপনাকে শুভেচ্ছা।’ মাহীর বক্তব্য হলো, সে খালেদা জিয়ার ছেলের (তারেক রহমান) সঙ্গে আলাপ করেছে। ও তাঁকে ‘তারেক ভাই’ ডাকত। তিনি তাকে বলেছিলেন, তোরণ করো, কোনো সমস্যা নেই। আমিও বললাম, ঠিক আছে, ভালো কাজ, করো। এটি রাজনৈতিক মহত্ত্ব দেখানোর জন্য করা হয়েছিল, কিন্তু দলের অনেকে পছন্দ করেননি। তাঁরা না-ও করতে পারেন, তা তাঁদের স্বাধীনতা। আমি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছি, কোনো উপসংহার টানছি না, কোনো সিদ্ধান্তও দিচ্ছি না।

তারপর?
তিনি (খালেদা জিয়া) অসুস্থ হয়ে আমেরিকা যাওয়ার আগে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হাঁটুর ব্যথার কী করা উচিত?’ বললাম, সবাই যা করে সেটিই ভালো চিকিৎসা, আজকাল ‘নি রিপ্লেসমেন্ট’ করে, স্টিলের বডি দিয়ে হাঁটু বানিয়ে রিপ্লেস করে। শেষ পর্যন্ত এটাই করতে হয়। তবে আমি তো সার্জন নই, আরো ডাক্তারের মতামত নেওয়া উচিত। তাঁর সঙ্গে সাবধানে কথা বলতাম। পরে কোনো এক কাগজে দেখলাম, আমাদের এক নেতার ভাষ্যে লিখেছে, আমার সঙ্গে তিনি আলাপ করেছিলেন। স্যার বলেছেন, হাঁটু কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে। তোষণ করার জন্য এমন অর্বাচীন কথাও কেউ বলতে পারে? পরে শুনলাম, এটাই অনেকটা ইস্যু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে অপারেশনের আগে টেলিফোনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। যেদিন তাঁর অপারেশন হলো, আমার পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হলো। অথচ পরে বলা হলো, আমি নাকি তাঁর খোঁজ নিইনি। এ কথা তিনি হয়তো জানেন না, কিন্তু বলা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনাটি হলো, আমি নাকি জিয়াউর রহমানের প্রতি সম্মান দেখাইনি।

কেন ফুল দিতে যাননি?
কোনো টেলিভিশনে এসব কথা কখনো বলিনি। এগুলো না বলাই উচিত। এ ব্যাপারে আমার বিবৃতি আছে, সেটি দেখুন। জিয়াউর রহমান আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা ছাড়া রাজনীতিবিদ ও বন্ধুদের মধ্যে আমার মতো সে সময় তাঁর এত কাছাকাছি আর কেউ ছিলেন না বলে লোকে বলে। তাঁর প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমি তাঁকে ভুলিনি। সুতরাং তাঁর প্রতি আমার অশ্রদ্ধার কথা যদি কেউ বলে সেগুলো ফালতু, মিথ্যা কথা।

বিএনপিতে আপনার অনুসারী অথবা সুধী সমাজ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?
না, কেউই আমার কাছে আসেননি, কেউ না। তাঁরা জানতেন, তা কোনো কাজে লাগবে না। পার্টিতে যখন মিটিং হচ্ছিল, এমপি-মন্ত্রীরা কড়াভাবেই আমার সমালোচনা করেছিলেন। তবে দু-একজন বলেছেন, ম্যাডাম এটা পার্টিতে আলোচনা না করে আপনারা সিনিয়ররা অনেকেই আছেন, আপনারা একত্রে আলোচনা করেন। এটি তো রাষ্ট্রপতির ব্যাপার। তখন তাঁরা বললেন, এটা পাওয়ার অব দ্য পার্টি। তবে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ-ভারতের ইতিহাসে আছে, দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বা কোনো মন্ত্রীর রাজনৈতিক মতানৈক্য হয়ে থাকে এবং হওয়ার পর তাঁরা পদত্যাগ করেন। এটা সহজ নিয়ম। আমি সেভাবেই নিয়েছি। তারা আমার বিরুদ্ধে নো-কনফিডেন্স মোশন (অনাস্থা প্রস্তাব) আনল। লোকে বলে, আমরা ভদ্র বংশের লোক, তাই ইজ্জত-বেইজ্জত আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আমি থাকিনি। আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি, যা হওয়ার তাদেরই হয়েছে। আমি তো রাষ্ট্রপতি হয়েই গেছি, আর কি?

খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?
তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করেননি। সুতরাং আমিও চেষ্টা করিনি।

পদত্যাগের পর তো ভয়ংকর সময় কেটেছে?
দুঃসময় গেছে। পাথর মেরে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তাঁর কারখানার যেসব পণ্য রপ্তানির জন্য চট্টগ্রামে ছিল, জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁর বিভিন্ন কারখানায় আক্রমণ করা হয়েছে। মাহীর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দিয়েছে। আমার পেছনে পিস্তল দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গেছে। তখনই বুঝেছি, নির্বাচন করে লাভ নেই। সেটাই হলো। পাঁচবার এমপি হওয়ার পর জীবনে এই প্রথম নির্বাচনে হারলাম।

নতুন দল করলেন কেন?
আমার মনে হলো, আমাদের দেশের লোক সন্ত্রাস ও দুর্নীতি পছন্দ করে না। তারা গণতন্ত্র চায়। দুই দলের রাজনীতির ভেতরই তখন সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ঢুকে গেছে। সেটির প্রতিবাদী, একটি সত্যিকারের উদার গণতান্ত্রিক এবং একটি জাতীয়তাবাদী কণ্ঠস্বর থাকা উচিত। দেশের লোক আমাকে সমর্থন দিল কি দিল না, সেটি পরের কথা; কিন্তু এমন একটি দল থাকা উচিত, যেখানে তারা চাইলে ভবিষ্যতে আসতে পারে, এই দল সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আছে।   

বিকল্প ধারার কার্যক্রম কেমন চলছে?
প্রথম থেকেই যেভাবে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর আর বেশি সুবিধা করতে পারিনি। দেশের রাজনীতির এখন যে অবস্থা, তাতে বিকল্প ধারা বেশি সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না; কিন্তু ড. কামাল হোসেন যেমন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে বলেন, আমরাও বলি। যেখানে যখন দরকার, আমরা বলি।  

৭ অক্টোবর, ২০১৬

source





 

No comments:

Post a Comment